কুরআন আল্লাহর বাণী ( প্রসঙ্গ পৃথিবীর গতি )
পৃথিবী ঘুরছে কথাটি এখন আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে বদ্ধ মূলে রূপান্তরিত হয়েছে। উপগ্রহের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে তা অবলোকন করছে, যাতে আলোচনা বা দ্বন্দ্বের অবকাশ রাখে না। রকেটের মাধ্যমে সৌরজগৎ পরিভ্রমণ কারীগণ যেভাবে দেখেছেন, ফটো উঠিয়েছেন, তা কোন জ্ঞানীর পক্ষে অস্বীকার করার মত নয়। ‘পৃথিবী ঘুরছে এর প্রমাণ হিসেবে আমরা এখানে চন্দ্র গ্রহণ সূর্য গ্রহণ, দিবারাত্র, ঋতুর আগমনকে পেষ করার প্রয়োজন মনে করছি না, কারণ এগুলো বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদী যা মখূর্ ও অহংকারী ব্যক্তি ব্যতীত কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু এ বিষয়ে চৌদ্দ শত বছর পূর্বে কুরআন যা বর্ণনা করেছে তা আমরা এখানে উপস্থাপন করতে চাই, যা সত্যিকার অর্থে মানব জাতিকে তাক লাগিয়ো দিয়েছে এবং কুরআনের সামনে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রথম দলিল : আলাহ তা‘আলা বলেন,
وهو الذي خلق الليل والنهار والشمس والقمر كل في ملك يسبحون ( سورة الأنبياء 33)
তিনি রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটাই কক্ষ পথে বিচরণ করছে। (সূরা আম্বিয়া-৩৩)
এই আয়াততে পৃথিবী ঘুরছে এমন সুক্ষ্য ইঙ্গিত বহন করছে। এখানে রাত ও দিনের সময়কে উলেখ করে পৃথিবীকে বুঝান হয়েছে। কেননা রাত ও দিন পৃথিবীতেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। যদি পৃথিবী না থাকতো তবে আলো ও অন্ধকার প্রকাশ পেত না, কোন রাত ও দিনের আবির্ভাব ঘটতো না। এই আয়াতে রাত দিন উল্লেখ করে যেন আলাহ রাব্বুল আলামীন এভাবে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ পৃথিবী, চন্দ্র সূর্য প্রত্যেকটি এই বিশাল সৌরজগতের কক্ষপথে ঘুরছে। আরবী ভাষার সৃষ্টি শব্দটি মর্মস্পর্শকৃত কোন জিনিসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে যাকে। তবে এই আয়াতে দিন ও রাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন তিনি রাত ও দিন অর্থাৎ অন্ধকার ও আলো সৃষ্টি করেছেন। অন্ধকার ও আলো কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অন্য আয়াতে এরশাদ করেন।
الحمد لله الذي خلق السموات والأرض وجعل الظلمات والنور ( سورة الأنعام )
সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলোর উদ্ভব করেছেন। (সূরা আনআম ৬:১)
এখানে আসমান ও জমিনের ব্যাপারে খালাকা শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং আলো ও অন্ধকারের ব্যাপারে যায়ালা শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেহেতু সেই আয়াতে রাত ও দিনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। সেহেতু বলা যায় যে, এখানে স্থান অর্থাৎ পৃথিবীকে বুঝান হয়েছে। এমন বহু উদাহরণ কুরআন ও আরবী ভাষায় রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وأما الذين ابيضت وجوههم ففي رحمة الله وهم فيها خالدون (سورة آل عمران 107)
আর যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা থাকবে আল্লাহর রহমতের মধ্যে, তাতে তারা অনন্ত কাল অবস্থান করবে।(সুরা আল ইমরান ৪:১০৭)
এখানে আল্লাহর রহমত বলতে জান্নাতকে বুঝান হয়েছে। অন্য আয়াতে রয়েছে,
وينزل لكم من السماء رزقا ( سورة عافر 13)
তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য রিজিক নাজিল করেন।
অর্থাৎ তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বষর্ণ করেন যার কারণে রিজিক উৎপন্ন হয়ে থাকে। এমন কোন আলেম ও জ্ঞানী একথা বলেন না যে আসমান থেকে চাল ডাল, শাক-শব্জি ও ফল অবতীর্ণ হয়। (দুই) উলেখিত আয়াতে বলা হচ্ছে,كل في فلك يسبحون প্রত্যেকটি সৌরজগতে ঘুরছে। যদি শুধুমাত্র সূর্য ও চন্দ্র ঘোরার কথা বলা হতো, তবে বহু বচন ব্যবহার না করে দ্বিবচন শব্দ ব্যবহার করা হতো। তাই বলা যায় যে, রাত ও দিন থেকে পৃথিবীকে বুঝান হয়েছে অতএব পৃথিবী, সূর্য ও চন্দ্র প্রতিটাই মহা শূন্যে নিজ নিজ কক্ষ পথে ঘুরছে। তবে প্রশ্ন হতে পারে যে, কুরআন কেন পৃথিবী ঘুরছে এমনভাবে স্পষ্ট করে সরাসরি বর্ণনা করল না, যেমন করে সূর্য ও চন্দ্রের ব্যাপারে বর্ণনা করেছে? পবিত্র কুরআন স্বীয় বর্ণনায় হিকমত অবলম্বন করেছে। তাই কুরআন সব যুগের গ্রহণযোগ্যতার অধিকারী হয়েছে। যে যুগে এই কুরআন নাজিল হয়েছে, সেই যুগে কোন সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হয়নি। সেই সময় যদি ‘পৃথিবী সূক্ষ্ম ঘুরছে’ এমন কথা সরাসরি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতো, তবে মানুষের ধারণ ক্ষমতার বাইরে তাদের জ্ঞানে তা গ্রহণ করতে পারতো না। যেহেতু তাদের কাছে এটাকে প্রমাণ করার মতো কোন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়নি বলে বিশ্বজগতের তত্ত্বসমূহ অপ্রকাশিত ছিল। তাই তাদের এ ব্যাপারে গ্রহণ যোগ্যতা হারিয়ে যেতো, এটাকে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার সুযোগ পেতো এবং এটাকে অস্বীকার করতো। মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অবস্থা বুঝে বর্ণনা করা কি হিকমত নয়? এ ব্যাপারে আর একটি সুন্দর উপমা রয়েছে, যেমন যানবাহনের ব্যবহারে ব্যাপারে যদি কুরআন সেই সময় বর্ণনা করতো যে, যানবাহনের মাধ্যম শুধু মাত্র ঘোড়া, গাধা ও খচ্চর নয় এবং তোমরা অনতিবিলম্বে গাড়ি, বাস, রেলগাড়িতে আরোহণ করবে, যা ঘোড়া দিয়ে টানতে হবে না। শুধু তাই নয় বরং তোমরা আসমানে হেলিকপ্টার, বিমান ও রকেটের মাধ্যমে মহাশূন্যে উড়ে বেড়াবে। তবে অবশ্যই তারা তখন কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য দ্রুত ধাবিত হতো। আর এই কারণেই কুরআন তার অলৌকিক পদ্ধতিতে এমন ভাবে বর্ণনা করেছে যা মানুষের আঁকল ও বিবেক তা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। তাহলে আসুন দেখা যাক কুরআনের সেই বাণীর দিকে।আলাহ তা‘আলা বলেন:
والخيل والبغال والحمير لتركبوها وزينة ويخلق مالا تعلمون (سورة النحل 8)
তোমাদের আরোহণের জন্য এবং শোভার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া খচ্চর ও গাধা এবং তিনি এমন জিনিস সৃষ্টি করবেন যা তোমরা জান না। (সূরা নাহল ১৬: ৮)
অর্থাৎ গাড়ি, রেলগাড়ি, বিমান, রকেট ও মহাশূন্য যান ইত্যাদি। আর এগুলো মহান করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি ও সামর্থ্য দান করেছেন, যার মাধ্যমে মানুষ আজ এ ধরনের বিভিন্ন আশ্চর্য যন্ত্রপাতির আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে ও হচ্ছে এবং আরও হবে ইনশা আল্লাহ। আলাহ তা‘আলা বলেন :
الذي أعطى كل شيء خلقه ثم هدي (سورة طه 50)
তিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্যতা অনুসারে আকৃতি দান করেছেন। অতপর পথ প্রদর্শন করেছেন। (সূরা তাহা ২০:৫০)
আর এই রহস্যের কারণেই সেই আয়াতে রাত দিন উল্লেখ করে পৃথিবীকেই বুঝান হয়েছে। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অণু পরমাণু থেকে আরম্ভ করে অতি বিশাল বিশাল গ্যলাক্সি এই কুলু শব্দটির আওতাভুক্ত। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করছে মহাবিশ্বে অতি ক্ষুদ্র অণু পরমাণুতে রয়েছে ইলেকট্রন ও প্রোটন। এই ইলেকট্রন ও প্রোটন পরমাণুর ভিতরে ঘুরতে থাকে। অতএব এই জগতে কোন কিছুই স্থির নেই এবং প্রত্যেকটিই ঘুরছে।
দ্বিতীয় দলিল : আলাহ তা‘আলা বলেন:
وآية لهم الليل نسلخ منه النهار فإذا هم مظلمون والشمس تجري لمستقر لها ذلك تقدير العزيز العليم و القمر قدرناه منازل حتى عاد كالعرجون القديم لا الشمس ينبغي لها أن تدرك القمر ولا الليل سابق النهار وكل في ذلك يسبحون (سورة يس .37-40)
রাত্রি তাদের জন্য একটি নির্দেশন, আমি তা থেকে দিনকে অপসারিত করি, তখনই তারা অন্ধকারে থেকে যায়। সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে চলতে থাকে। এটা পরাম শালী, সর্বজ্ঞ আলাহর নিয়ন্ত্রণ চন্দ্রের জন্য আমি বিভিন্ন মনজিল নির্ধারিত করেছি, অবশেষে সে পুরাতন খেজুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্য চন্দ্রের নাগাল পেতে পারে না। এবং রাত্রি দিনের অগ্রে চলে না। প্রত্যেকটি তার কক্ষ পথে বিচরণ করছে। (সূরা ইয়াসীন ৩৭-৪০)
আলোচ্য আয়াত গুলোতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় কুদরত বর্ণনা শেষে বলছেন: ‘‘প্রত্যেকটি কক্ষ পথে বিচরণ করছে’’। এই প্রসঙ্গে সর্ব প্রথম পৃথিবীর কথা উলেখ করেছেন যা আলোচ্য আয়াত গুলোতে পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। অতপর পানি বষর্ণ করে বৃক্ষ ও উদ্ভিদ উৎপন্ন করার কথা উল্লেখ করেছেন। এর পর দিবা ও রাত্রি দৈনন্দিন পরিবর্তনের উল্লেখ করেছেন। এরপর সর্ববৃহৎ সূর্য ও উপগ্রহ চন্দ্রের আলোচনার পরিশেষে আল্লাহ তা’আলা বলেন : "প্রত্যেকটি তার কক্ষ পথে বিচরণ করছে।" এখানে শব্দটি পৃথিবী, সূর্য ও চন্দ্র সহ সব কিছুকে অন্তভুর্ক্ত করে তাই বহু বচন ব্যবহার হয়েছে। এই কথাটা যদি সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, তবে দ্বিবচন ব্যবহার হতো। অতএব বর্তমান আধুনিক যুগের আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, পবিত্র কুরআন সর্বকালীন উপযোগী, সময় ও পরিবেশের প্রেক্ষিতে নব নব তথ্য হাজির করে বিশ্ববাসীর কাছে।
তৃতীয় দলীল : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন :
إن الله يمسك السماوات والأرض أن تزولا , ولإن زالتا إن أمسكهما من أحد من بعده ، إنه كان حليما غفورا ( سورة فاطر 41)
নিশ্চয়ই আল্লাহ আসমান ও জমিনকে ধরে রেখেছেন, যাতে স্থানচ্যুত না হয় । যদি এগুলো স্থানচ্যুত হয়ে যায়, তবে তিনি ব্যতীত কে এগুলো ধরে রাখবে। তিনি সহনশীল ও ক্ষমা পরায়ণ। (সুরা ফাতের ৩৫: ৪১)
আমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনি তার কুদরতের হাত দিয়ে আসমান ও পৃথিবীকে ধরে রেখেছেন যাতে হেলে দুলে, ও স্বস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে না যায়। যদি কোন কিছুর উপর থেমে থাকত তবে তা ধরা ও সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল না। যেমন করে আল্লাহ তার কুদরত দিয়ে আসমান কে ধরে রেখেছেন যাতে পৃথিবীর উপর পতিত না হয়। তেমনি ভাবে, তিনি পৃথিবীকে তার কুদরতের হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন যাতে, হেলে দুলে না যায় এবং সূর্যের নিকটবর্তী না হয় অথবা সূর্য থেকে দুরে সরে না যায়। কারণ উভয়টাই মহাবিপদ জনক। আধুনিক বিজ্ঞানে প্রকাশ পৃথিবী আপন মেরুর উপর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে ঘুরছে। অন্য কথায় বলতে গেলে তা আপন মেরুর উপর প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার মাইল বেগে চলছে। মনে করুন, যদি এর গতি প্রতি ঘণ্টায় দুইশ মাইল হয়ে যায় (এরূপ হওয়া একেবারেই অসম্ভব) তাহলে আমাদের দিন এবং আমদের রাত্র বর্তমানের অনুপাতে দশগুণ বেশী দীর্ঘ হয়ে যাবে। অত্যধিক রকমের উত্তপ্ত সূর্য প্রতি দিন যাবতীয় লতাগুল্ম জ্বালিয়ে দেবে। এতদসত্ত্বেও সামান্য যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে সেগুলোকে দীর্ঘ রাতের শীতলতা চিরদিনের জন্য খতম করে দেবে। সূর্য, যা এখন আমাদের জীবনের উৎস তার পৃষ্ঠদেশে বারো হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা রয়েছে এবং পৃথিবী থেকে এর দুরত্ব আনুমানিক ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। আর এই দুরত্ব বিস্ময়করভাবে অনবরত স্থিতিশীল। এই ঘটনা আমাদের জন্য সীমাহীন গুরুত্ব রাখে। কেননা যদি এই দূরত্ব হ্রাস পায় যেমন সূর্য অর্ধেক পরিমাণ নিকটবর্তী হয়ে যায়, তাহলে জমির উপর এত উষ্ণতার সৃষ্টি হবে যে, সেই গরমে কাগজ পুড়তে থাকবে, আর যদি বর্তমান দূরত্ব দ্বিগুণ হয়ে যায় তাহলে এমন শীতলতার সৃষ্টি হবে যে, তাতে জীবনের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। এই অবস্থা তখন সৃষ্টি হবে যখন বর্তমান সূর্যের জায়গায় অন্য কোন অসাধারণ নক্ষত্র এসে পড়বে-এমন বৃহৎ নক্ষত্র, যার উষ্ণতা আমাদের সূর্যের চাইতে দশ হাজার গুণ বেশী। যদি ঐ নক্ষত্র সূর্যের জায়গায় হত তাহলে তা পৃথিবীকে নির্ঘাত আগুনের চুলিতে পরিণত করত। পৃথিবী ২৩ ডিগ্রি কোণাকারে শূন্যে ঝুঁকে আছে। এই ঝুঁকে থাকাটাই আমাদেরকে ঋতুর অধিকারী করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে জমির বেশীর ভাগ অংশ আবাদের যোগ্য হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন ধরনের লতাগুল্ম এবং ফলমূল উৎপাদিত হচ্ছে। পৃথিবী যদি এভাবে ঝুঁকে না থাকত তাহলে দুই মেরুর উপর সর্বদা অন্ধকার ছেয়ে থাকতো। ফলে সমুদ্রের বাষ্পসমূহ উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে পরিভ্রমণ করত এবং জমি হয় তুষার আবৃত থাকত, নয় মরুভূমিতে পরিণত হত। এ ছাড়াও আরো অনেক চিহ্নাদি ফুটে উঠত যার ফলশ্রুতিতে ঝোঁকবিহীন পৃথিবীর উপর জীবনের অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে উঠত। এটা কত অবিশ্বাস্য কথা যে, জড় বস্তু নিজেই নিজেকে এভাবে এত সুন্দর করে ও যথার্থ আকার সুবিন্যস্ত করে নিয়েছে।
চতুর্থ দলিল : আলাহ তা‘আলা বলেন :
وتري الجبال تحسبها جامدة وهي تمرمر السحاب ,صنع الله الذي أتقن كل شئ إنه خبير بما تفعلون ( سورة النمل /88)
তুমি পাহাড়সমূকে অচল ও স্থিতিশীল অবস্থায় দেখছ অথচ সেগুলো মেঘের ন্যায় চলছে এটা আল্লাহর কারিগরি যিনি সব কিছুকে সুসংহত করেছেন। তোমরা যা কিছু করছ তিনি তা অবগত আছেন। (সুরা নামল ২৭:৮৮)
এখানে মানব জাতিকে এই দুনিয়াতে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেক দৃষ্টি ও জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিকে চিন্তা ও গবেষণা করার জন্য আহ্বান করছেন যে, কত সুন্দর সুদৃঢ় ও সুবিন্যস্ত নিয়মের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে এই বিশ্বজগৎ। রকেটে মহাকাশ পাড়ি দিতে যাত্রীকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। নতুবা জীবনের ঝুঁকি থাকে। তার এ সতর্কতার মধ্যে রয়েছে অভিকর্ষ তাপ ও চাপ সম্পর্কিত ব্যবস্থা। অথচ এ রকেটের বেগ মাত্র ঘণ্টায় পঁচিশ হাজার মাইল কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যে পৃথিবী নামক রকেটে করে আমরা এক অনন্ত যাত্রার আরোহী তার বেগ ঘণ্টায় ৬৭০০০ মাইল। এত বিপুল বেগে চলছি অথচ কোন রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থার বালাই নেই। কি অভাবনীয় ব্যবস্থা পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারদিকে, আবার সূর্য অনুরূপ ব্যবস্থা বরাবর ঘুরতে ঘুরতে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমার তা কিছুই জানি না। এর কোন খবরই আমাদের জানা নেই। তাই আল্লাহ জানিয়ে দিলেন :
صنع الله الذي أتقن كل شئ ( سورة النمل /88)
(ঐটা) আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্য যিনি সবকিছু সুষম করেছেন। (সূরা নমল ২৭: ৮৮)
আমাদের মাঝে অনেকের ধারণা আয়াতটিতে আখেরাতের অবস্থা বর্ণনা হয়েছে পৃথিবীর অবস্থা নয়, যেহেতু আয়াতটির পূর্বের আয়াতে আখেরাতের বর্ণনা রয়েছে। আব্দুল মাজীদ ঝিন্দানী স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, কিছু তাফসীর কারক গণের অভিমত যে, উক্ত আয়াতে পৃথিবীর অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এবং এতে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে পৃথিবী ঘুরছে। তারা অস্বীকার করেছে যে, এ অবস্থা কিয়ামতের নয়। কেননা কিয়ামত দিবসে মানুষদেরকে এমন জমিনে উঠান হবে যাতে কোন পাহাড় থাকবে না। নবী করীম (স.) এরশাদ করেন:
يحشر الناس يوم القيامة علي أرض بيضاء , عفراء ، كقرصة النقي ,ليس فيها علم لأحد .(رواه البخاري 11/323 )
কিয়ামতের দিন মানুষকে এমন জমিনে একত্রিত করা হবে সেটা সাদা লাল মিশ্রিত রঙ্গের হবে, পরিষ্কার সমতল ভূমির ন্যায়। তাতে থাকবে না কারো কোন চিহ্ন। (বুখারী শরীফ) ১১/৩২৩
যদি বলা হয় যে, পাহাড়ের দৃশ্যের অবস্থা কিয়ামতের নয় বরং কিয়ামতের পূর্বের শিঙায় ফুৎকার দেয়ার সময়ের দৃশ্য। আসলে শিঙার ফুৎকারের মাধ্যমে যখন বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে, তখন মানুষ থাকবে হয়রান, পেরেশান, ভীত, সন্ত্রস্ত ও নেশাগ্রস্থ ব্যক্তির ন্যায় জ্ঞান হারা হয়ে যাবে। সেই মুহূর্তের পাহাড়ের দিকে নজর দেয়ার কোন পরিবেশ থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
يأيها الناس اتقوا ربكم أن زلزلة الساعة شئ عظيم ,يوم ترونها تذهل كل مرضعة عما أرضعت وتضع كل ذات حمل حملها وتري الناس سكري وما هم بسكري ولكن عذاب الله شديد (سورة الحج 1-2)
হে লোক সকল! তোমাদের পালন কর্তাকে ভয় কর, নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যে দিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যধাত্রী তার দুধের শিশুকে বিস্মৃত হবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গভর্পাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল অথচ তারা মাতাল নয়। বস্তুত আল্লাহর আজাব সুকঠিন (সূরা হজ ২২: ১-৬)
আর একটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে, উক্ত আয়াতে আলাহ তা’আলা ব্যবহার করেছেন এখানে শব্দটি আরবী পরিভাষায় সৃষ্টি নৈপুণ্য সূক্ষ্মতা, সামঞ্জস্য পূর্ণ নিখুঁত তৈরীর ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলতার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না। অতএব আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, উক্ত আয়াতটি পৃথিবীর অবস্থা বর্ণনা করছে। আয়াতটির শেষ অংশ হচ্ছে অর্থাৎ নিশ্চয়ই তিনি অবগত আছেন (বর্তমানে পৃথিবীতে) তোমরা যা করছ। আখেরাত হচ্ছে, প্রতিদানের জন্য, যেখানে কোন কাজ নেই। অতএব আয়াতটি এটাই প্রমাণ করে যে এই অবস্থা দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক। আখেরাতের সাথে নয়। কোন কোন আলেমগণ ধারণা করছেন যে, পৃথিবী ঘুরছে না বরং স্থির রয়েছে। দলিল হিসেবে পেশ করছেন কুরআনের এমন আয়াত যাতে আল্লাহ তা’আলা বলেন :
أمن جعل الأرض قرارا وجعل خلا لها أنهارا وجعل لها رواسي (سورة النمل 61)
কে পৃথিবীকে স্থিত (বাসপযোগী) করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থির রাখার জন্য পর্বত স্থাপন করেছেন? (সূরা নমল ২৭:৬১)
এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে তারা বলেন , তোমরা কীভাবে বলছ যে, পৃথিবী ঘুরছে অথচ আলাহ বলছেন পৃথিবী স্থির? এই প্রশ্নটির জওয়াব সুন্দর করে দিয়েছে আব্দুল মাজিদ ঝান্দানী। তিনি বলেন প্রত্যেকটি নড়াচড়া অন্য কিছুর সাথে সম্পর্কিত। যেমন আপনি কোন বিমানে আরোহণ করেছেন। আপনি এই বিমানে স্থির রয়েছেন, কোন নড়াচড়া হচ্ছে না কিন্তু বিমানটি আপনাকে নিয়ে চলছে। আপনি বিমানের জন্য স্থির আর বিমানটি পৃথিবীর জন্য চলমান। একস্থান থেকে অন্য স্থানে চলে গিয়েছে। অতএব নড়াচড়া অবশ্যই অন্য কিছুর সাথে সম্পর্কিত। এর উত্তর আমরা পবিত্র কুরআনেই পেয়ে থাকি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
الله الذي جعل لكم الأرض قرارا (سورة غافر 64)
আল্লাহ তোমাদের জন্য পৃথিবীকে স্থির করেছেন। (সূরা গাফের ৬৪)
পৃথিবীর ঘুরছে এমন অবস্থায়ও তোমাদের জন্য স্থির করে বসবাসের উপযোগী করেছেন। এতেই মহানকরুণাময় আল্লাহর কুদরতের সবচেয়ে বেশী বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
প্রথম দলিল : আলাহ তা‘আলা বলেন,
وهو الذي خلق الليل والنهار والشمس والقمر كل في ملك يسبحون ( سورة الأنبياء 33)
তিনি রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটাই কক্ষ পথে বিচরণ করছে। (সূরা আম্বিয়া-৩৩)
এই আয়াততে পৃথিবী ঘুরছে এমন সুক্ষ্য ইঙ্গিত বহন করছে। এখানে রাত ও দিনের সময়কে উলেখ করে পৃথিবীকে বুঝান হয়েছে। কেননা রাত ও দিন পৃথিবীতেই প্রকাশ পেয়ে থাকে। যদি পৃথিবী না থাকতো তবে আলো ও অন্ধকার প্রকাশ পেত না, কোন রাত ও দিনের আবির্ভাব ঘটতো না। এই আয়াতে রাত দিন উল্লেখ করে যেন আলাহ রাব্বুল আলামীন এভাবে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ পৃথিবী, চন্দ্র সূর্য প্রত্যেকটি এই বিশাল সৌরজগতের কক্ষপথে ঘুরছে। আরবী ভাষার সৃষ্টি শব্দটি মর্মস্পর্শকৃত কোন জিনিসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে যাকে। তবে এই আয়াতে দিন ও রাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন তিনি রাত ও দিন অর্থাৎ অন্ধকার ও আলো সৃষ্টি করেছেন। অন্ধকার ও আলো কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অন্য আয়াতে এরশাদ করেন।
الحمد لله الذي خلق السموات والأرض وجعل الظلمات والنور ( سورة الأنعام )
সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলোর উদ্ভব করেছেন। (সূরা আনআম ৬:১)
এখানে আসমান ও জমিনের ব্যাপারে খালাকা শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং আলো ও অন্ধকারের ব্যাপারে যায়ালা শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেহেতু সেই আয়াতে রাত ও দিনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। সেহেতু বলা যায় যে, এখানে স্থান অর্থাৎ পৃথিবীকে বুঝান হয়েছে। এমন বহু উদাহরণ কুরআন ও আরবী ভাষায় রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وأما الذين ابيضت وجوههم ففي رحمة الله وهم فيها خالدون (سورة آل عمران 107)
আর যাদের মুখ উজ্জ্বল হবে, তারা থাকবে আল্লাহর রহমতের মধ্যে, তাতে তারা অনন্ত কাল অবস্থান করবে।(সুরা আল ইমরান ৪:১০৭)
এখানে আল্লাহর রহমত বলতে জান্নাতকে বুঝান হয়েছে। অন্য আয়াতে রয়েছে,
وينزل لكم من السماء رزقا ( سورة عافر 13)
তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য রিজিক নাজিল করেন।
অর্থাৎ তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বষর্ণ করেন যার কারণে রিজিক উৎপন্ন হয়ে থাকে। এমন কোন আলেম ও জ্ঞানী একথা বলেন না যে আসমান থেকে চাল ডাল, শাক-শব্জি ও ফল অবতীর্ণ হয়। (দুই) উলেখিত আয়াতে বলা হচ্ছে,كل في فلك يسبحون প্রত্যেকটি সৌরজগতে ঘুরছে। যদি শুধুমাত্র সূর্য ও চন্দ্র ঘোরার কথা বলা হতো, তবে বহু বচন ব্যবহার না করে দ্বিবচন শব্দ ব্যবহার করা হতো। তাই বলা যায় যে, রাত ও দিন থেকে পৃথিবীকে বুঝান হয়েছে অতএব পৃথিবী, সূর্য ও চন্দ্র প্রতিটাই মহা শূন্যে নিজ নিজ কক্ষ পথে ঘুরছে। তবে প্রশ্ন হতে পারে যে, কুরআন কেন পৃথিবী ঘুরছে এমনভাবে স্পষ্ট করে সরাসরি বর্ণনা করল না, যেমন করে সূর্য ও চন্দ্রের ব্যাপারে বর্ণনা করেছে? পবিত্র কুরআন স্বীয় বর্ণনায় হিকমত অবলম্বন করেছে। তাই কুরআন সব যুগের গ্রহণযোগ্যতার অধিকারী হয়েছে। যে যুগে এই কুরআন নাজিল হয়েছে, সেই যুগে কোন সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হয়নি। সেই সময় যদি ‘পৃথিবী সূক্ষ্ম ঘুরছে’ এমন কথা সরাসরি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতো, তবে মানুষের ধারণ ক্ষমতার বাইরে তাদের জ্ঞানে তা গ্রহণ করতে পারতো না। যেহেতু তাদের কাছে এটাকে প্রমাণ করার মতো কোন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়নি বলে বিশ্বজগতের তত্ত্বসমূহ অপ্রকাশিত ছিল। তাই তাদের এ ব্যাপারে গ্রহণ যোগ্যতা হারিয়ে যেতো, এটাকে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার সুযোগ পেতো এবং এটাকে অস্বীকার করতো। মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অবস্থা বুঝে বর্ণনা করা কি হিকমত নয়? এ ব্যাপারে আর একটি সুন্দর উপমা রয়েছে, যেমন যানবাহনের ব্যবহারে ব্যাপারে যদি কুরআন সেই সময় বর্ণনা করতো যে, যানবাহনের মাধ্যম শুধু মাত্র ঘোড়া, গাধা ও খচ্চর নয় এবং তোমরা অনতিবিলম্বে গাড়ি, বাস, রেলগাড়িতে আরোহণ করবে, যা ঘোড়া দিয়ে টানতে হবে না। শুধু তাই নয় বরং তোমরা আসমানে হেলিকপ্টার, বিমান ও রকেটের মাধ্যমে মহাশূন্যে উড়ে বেড়াবে। তবে অবশ্যই তারা তখন কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য দ্রুত ধাবিত হতো। আর এই কারণেই কুরআন তার অলৌকিক পদ্ধতিতে এমন ভাবে বর্ণনা করেছে যা মানুষের আঁকল ও বিবেক তা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। তাহলে আসুন দেখা যাক কুরআনের সেই বাণীর দিকে।আলাহ তা‘আলা বলেন:
والخيل والبغال والحمير لتركبوها وزينة ويخلق مالا تعلمون (سورة النحل 8)
তোমাদের আরোহণের জন্য এবং শোভার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া খচ্চর ও গাধা এবং তিনি এমন জিনিস সৃষ্টি করবেন যা তোমরা জান না। (সূরা নাহল ১৬: ৮)
অর্থাৎ গাড়ি, রেলগাড়ি, বিমান, রকেট ও মহাশূন্য যান ইত্যাদি। আর এগুলো মহান করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি ও সামর্থ্য দান করেছেন, যার মাধ্যমে মানুষ আজ এ ধরনের বিভিন্ন আশ্চর্য যন্ত্রপাতির আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে ও হচ্ছে এবং আরও হবে ইনশা আল্লাহ। আলাহ তা‘আলা বলেন :
الذي أعطى كل شيء خلقه ثم هدي (سورة طه 50)
তিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্যতা অনুসারে আকৃতি দান করেছেন। অতপর পথ প্রদর্শন করেছেন। (সূরা তাহা ২০:৫০)
আর এই রহস্যের কারণেই সেই আয়াতে রাত দিন উল্লেখ করে পৃথিবীকেই বুঝান হয়েছে। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অণু পরমাণু থেকে আরম্ভ করে অতি বিশাল বিশাল গ্যলাক্সি এই কুলু শব্দটির আওতাভুক্ত। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করছে মহাবিশ্বে অতি ক্ষুদ্র অণু পরমাণুতে রয়েছে ইলেকট্রন ও প্রোটন। এই ইলেকট্রন ও প্রোটন পরমাণুর ভিতরে ঘুরতে থাকে। অতএব এই জগতে কোন কিছুই স্থির নেই এবং প্রত্যেকটিই ঘুরছে।
দ্বিতীয় দলিল : আলাহ তা‘আলা বলেন:
وآية لهم الليل نسلخ منه النهار فإذا هم مظلمون والشمس تجري لمستقر لها ذلك تقدير العزيز العليم و القمر قدرناه منازل حتى عاد كالعرجون القديم لا الشمس ينبغي لها أن تدرك القمر ولا الليل سابق النهار وكل في ذلك يسبحون (سورة يس .37-40)
রাত্রি তাদের জন্য একটি নির্দেশন, আমি তা থেকে দিনকে অপসারিত করি, তখনই তারা অন্ধকারে থেকে যায়। সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে চলতে থাকে। এটা পরাম শালী, সর্বজ্ঞ আলাহর নিয়ন্ত্রণ চন্দ্রের জন্য আমি বিভিন্ন মনজিল নির্ধারিত করেছি, অবশেষে সে পুরাতন খেজুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্য চন্দ্রের নাগাল পেতে পারে না। এবং রাত্রি দিনের অগ্রে চলে না। প্রত্যেকটি তার কক্ষ পথে বিচরণ করছে। (সূরা ইয়াসীন ৩৭-৪০)
আলোচ্য আয়াত গুলোতে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় কুদরত বর্ণনা শেষে বলছেন: ‘‘প্রত্যেকটি কক্ষ পথে বিচরণ করছে’’। এই প্রসঙ্গে সর্ব প্রথম পৃথিবীর কথা উলেখ করেছেন যা আলোচ্য আয়াত গুলোতে পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। অতপর পানি বষর্ণ করে বৃক্ষ ও উদ্ভিদ উৎপন্ন করার কথা উল্লেখ করেছেন। এর পর দিবা ও রাত্রি দৈনন্দিন পরিবর্তনের উল্লেখ করেছেন। এরপর সর্ববৃহৎ সূর্য ও উপগ্রহ চন্দ্রের আলোচনার পরিশেষে আল্লাহ তা’আলা বলেন : "প্রত্যেকটি তার কক্ষ পথে বিচরণ করছে।" এখানে শব্দটি পৃথিবী, সূর্য ও চন্দ্র সহ সব কিছুকে অন্তভুর্ক্ত করে তাই বহু বচন ব্যবহার হয়েছে। এই কথাটা যদি সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, তবে দ্বিবচন ব্যবহার হতো। অতএব বর্তমান আধুনিক যুগের আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, পবিত্র কুরআন সর্বকালীন উপযোগী, সময় ও পরিবেশের প্রেক্ষিতে নব নব তথ্য হাজির করে বিশ্ববাসীর কাছে।
তৃতীয় দলীল : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন :
إن الله يمسك السماوات والأرض أن تزولا , ولإن زالتا إن أمسكهما من أحد من بعده ، إنه كان حليما غفورا ( سورة فاطر 41)
নিশ্চয়ই আল্লাহ আসমান ও জমিনকে ধরে রেখেছেন, যাতে স্থানচ্যুত না হয় । যদি এগুলো স্থানচ্যুত হয়ে যায়, তবে তিনি ব্যতীত কে এগুলো ধরে রাখবে। তিনি সহনশীল ও ক্ষমা পরায়ণ। (সুরা ফাতের ৩৫: ৪১)
আমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনি তার কুদরতের হাত দিয়ে আসমান ও পৃথিবীকে ধরে রেখেছেন যাতে হেলে দুলে, ও স্বস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে না যায়। যদি কোন কিছুর উপর থেমে থাকত তবে তা ধরা ও সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল না। যেমন করে আল্লাহ তার কুদরত দিয়ে আসমান কে ধরে রেখেছেন যাতে পৃথিবীর উপর পতিত না হয়। তেমনি ভাবে, তিনি পৃথিবীকে তার কুদরতের হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন যাতে, হেলে দুলে না যায় এবং সূর্যের নিকটবর্তী না হয় অথবা সূর্য থেকে দুরে সরে না যায়। কারণ উভয়টাই মহাবিপদ জনক। আধুনিক বিজ্ঞানে প্রকাশ পৃথিবী আপন মেরুর উপর প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার করে ঘুরছে। অন্য কথায় বলতে গেলে তা আপন মেরুর উপর প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার মাইল বেগে চলছে। মনে করুন, যদি এর গতি প্রতি ঘণ্টায় দুইশ মাইল হয়ে যায় (এরূপ হওয়া একেবারেই অসম্ভব) তাহলে আমাদের দিন এবং আমদের রাত্র বর্তমানের অনুপাতে দশগুণ বেশী দীর্ঘ হয়ে যাবে। অত্যধিক রকমের উত্তপ্ত সূর্য প্রতি দিন যাবতীয় লতাগুল্ম জ্বালিয়ে দেবে। এতদসত্ত্বেও সামান্য যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে সেগুলোকে দীর্ঘ রাতের শীতলতা চিরদিনের জন্য খতম করে দেবে। সূর্য, যা এখন আমাদের জীবনের উৎস তার পৃষ্ঠদেশে বারো হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা রয়েছে এবং পৃথিবী থেকে এর দুরত্ব আনুমানিক ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। আর এই দুরত্ব বিস্ময়করভাবে অনবরত স্থিতিশীল। এই ঘটনা আমাদের জন্য সীমাহীন গুরুত্ব রাখে। কেননা যদি এই দূরত্ব হ্রাস পায় যেমন সূর্য অর্ধেক পরিমাণ নিকটবর্তী হয়ে যায়, তাহলে জমির উপর এত উষ্ণতার সৃষ্টি হবে যে, সেই গরমে কাগজ পুড়তে থাকবে, আর যদি বর্তমান দূরত্ব দ্বিগুণ হয়ে যায় তাহলে এমন শীতলতার সৃষ্টি হবে যে, তাতে জীবনের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। এই অবস্থা তখন সৃষ্টি হবে যখন বর্তমান সূর্যের জায়গায় অন্য কোন অসাধারণ নক্ষত্র এসে পড়বে-এমন বৃহৎ নক্ষত্র, যার উষ্ণতা আমাদের সূর্যের চাইতে দশ হাজার গুণ বেশী। যদি ঐ নক্ষত্র সূর্যের জায়গায় হত তাহলে তা পৃথিবীকে নির্ঘাত আগুনের চুলিতে পরিণত করত। পৃথিবী ২৩ ডিগ্রি কোণাকারে শূন্যে ঝুঁকে আছে। এই ঝুঁকে থাকাটাই আমাদেরকে ঋতুর অধিকারী করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে জমির বেশীর ভাগ অংশ আবাদের যোগ্য হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন ধরনের লতাগুল্ম এবং ফলমূল উৎপাদিত হচ্ছে। পৃথিবী যদি এভাবে ঝুঁকে না থাকত তাহলে দুই মেরুর উপর সর্বদা অন্ধকার ছেয়ে থাকতো। ফলে সমুদ্রের বাষ্পসমূহ উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে পরিভ্রমণ করত এবং জমি হয় তুষার আবৃত থাকত, নয় মরুভূমিতে পরিণত হত। এ ছাড়াও আরো অনেক চিহ্নাদি ফুটে উঠত যার ফলশ্রুতিতে ঝোঁকবিহীন পৃথিবীর উপর জীবনের অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে উঠত। এটা কত অবিশ্বাস্য কথা যে, জড় বস্তু নিজেই নিজেকে এভাবে এত সুন্দর করে ও যথার্থ আকার সুবিন্যস্ত করে নিয়েছে।
চতুর্থ দলিল : আলাহ তা‘আলা বলেন :
وتري الجبال تحسبها جامدة وهي تمرمر السحاب ,صنع الله الذي أتقن كل شئ إنه خبير بما تفعلون ( سورة النمل /88)
তুমি পাহাড়সমূকে অচল ও স্থিতিশীল অবস্থায় দেখছ অথচ সেগুলো মেঘের ন্যায় চলছে এটা আল্লাহর কারিগরি যিনি সব কিছুকে সুসংহত করেছেন। তোমরা যা কিছু করছ তিনি তা অবগত আছেন। (সুরা নামল ২৭:৮৮)
এখানে মানব জাতিকে এই দুনিয়াতে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেক দৃষ্টি ও জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিকে চিন্তা ও গবেষণা করার জন্য আহ্বান করছেন যে, কত সুন্দর সুদৃঢ় ও সুবিন্যস্ত নিয়মের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে এই বিশ্বজগৎ। রকেটে মহাকাশ পাড়ি দিতে যাত্রীকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। নতুবা জীবনের ঝুঁকি থাকে। তার এ সতর্কতার মধ্যে রয়েছে অভিকর্ষ তাপ ও চাপ সম্পর্কিত ব্যবস্থা। অথচ এ রকেটের বেগ মাত্র ঘণ্টায় পঁচিশ হাজার মাইল কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যে পৃথিবী নামক রকেটে করে আমরা এক অনন্ত যাত্রার আরোহী তার বেগ ঘণ্টায় ৬৭০০০ মাইল। এত বিপুল বেগে চলছি অথচ কোন রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থার বালাই নেই। কি অভাবনীয় ব্যবস্থা পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ সূর্যের চারদিকে, আবার সূর্য অনুরূপ ব্যবস্থা বরাবর ঘুরতে ঘুরতে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমার তা কিছুই জানি না। এর কোন খবরই আমাদের জানা নেই। তাই আল্লাহ জানিয়ে দিলেন :
صنع الله الذي أتقن كل شئ ( سورة النمل /88)
(ঐটা) আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্য যিনি সবকিছু সুষম করেছেন। (সূরা নমল ২৭: ৮৮)
আমাদের মাঝে অনেকের ধারণা আয়াতটিতে আখেরাতের অবস্থা বর্ণনা হয়েছে পৃথিবীর অবস্থা নয়, যেহেতু আয়াতটির পূর্বের আয়াতে আখেরাতের বর্ণনা রয়েছে। আব্দুল মাজীদ ঝিন্দানী স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, কিছু তাফসীর কারক গণের অভিমত যে, উক্ত আয়াতে পৃথিবীর অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এবং এতে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে পৃথিবী ঘুরছে। তারা অস্বীকার করেছে যে, এ অবস্থা কিয়ামতের নয়। কেননা কিয়ামত দিবসে মানুষদেরকে এমন জমিনে উঠান হবে যাতে কোন পাহাড় থাকবে না। নবী করীম (স.) এরশাদ করেন:
يحشر الناس يوم القيامة علي أرض بيضاء , عفراء ، كقرصة النقي ,ليس فيها علم لأحد .(رواه البخاري 11/323 )
কিয়ামতের দিন মানুষকে এমন জমিনে একত্রিত করা হবে সেটা সাদা লাল মিশ্রিত রঙ্গের হবে, পরিষ্কার সমতল ভূমির ন্যায়। তাতে থাকবে না কারো কোন চিহ্ন। (বুখারী শরীফ) ১১/৩২৩
যদি বলা হয় যে, পাহাড়ের দৃশ্যের অবস্থা কিয়ামতের নয় বরং কিয়ামতের পূর্বের শিঙায় ফুৎকার দেয়ার সময়ের দৃশ্য। আসলে শিঙার ফুৎকারের মাধ্যমে যখন বিশ্বজগৎ ধ্বংস হবে, তখন মানুষ থাকবে হয়রান, পেরেশান, ভীত, সন্ত্রস্ত ও নেশাগ্রস্থ ব্যক্তির ন্যায় জ্ঞান হারা হয়ে যাবে। সেই মুহূর্তের পাহাড়ের দিকে নজর দেয়ার কোন পরিবেশ থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
يأيها الناس اتقوا ربكم أن زلزلة الساعة شئ عظيم ,يوم ترونها تذهل كل مرضعة عما أرضعت وتضع كل ذات حمل حملها وتري الناس سكري وما هم بسكري ولكن عذاب الله شديد (سورة الحج 1-2)
হে লোক সকল! তোমাদের পালন কর্তাকে ভয় কর, নিশ্চয় কেয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর ব্যাপার। যে দিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যধাত্রী তার দুধের শিশুকে বিস্মৃত হবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গভর্পাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল অথচ তারা মাতাল নয়। বস্তুত আল্লাহর আজাব সুকঠিন (সূরা হজ ২২: ১-৬)
আর একটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে, উক্ত আয়াতে আলাহ তা’আলা ব্যবহার করেছেন এখানে শব্দটি আরবী পরিভাষায় সৃষ্টি নৈপুণ্য সূক্ষ্মতা, সামঞ্জস্য পূর্ণ নিখুঁত তৈরীর ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলতার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না। অতএব আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, উক্ত আয়াতটি পৃথিবীর অবস্থা বর্ণনা করছে। আয়াতটির শেষ অংশ হচ্ছে অর্থাৎ নিশ্চয়ই তিনি অবগত আছেন (বর্তমানে পৃথিবীতে) তোমরা যা করছ। আখেরাত হচ্ছে, প্রতিদানের জন্য, যেখানে কোন কাজ নেই। অতএব আয়াতটি এটাই প্রমাণ করে যে এই অবস্থা দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক। আখেরাতের সাথে নয়। কোন কোন আলেমগণ ধারণা করছেন যে, পৃথিবী ঘুরছে না বরং স্থির রয়েছে। দলিল হিসেবে পেশ করছেন কুরআনের এমন আয়াত যাতে আল্লাহ তা’আলা বলেন :
أمن جعل الأرض قرارا وجعل خلا لها أنهارا وجعل لها رواسي (سورة النمل 61)
কে পৃথিবীকে স্থিত (বাসপযোগী) করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থির রাখার জন্য পর্বত স্থাপন করেছেন? (সূরা নমল ২৭:৬১)
এ আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে তারা বলেন , তোমরা কীভাবে বলছ যে, পৃথিবী ঘুরছে অথচ আলাহ বলছেন পৃথিবী স্থির? এই প্রশ্নটির জওয়াব সুন্দর করে দিয়েছে আব্দুল মাজিদ ঝান্দানী। তিনি বলেন প্রত্যেকটি নড়াচড়া অন্য কিছুর সাথে সম্পর্কিত। যেমন আপনি কোন বিমানে আরোহণ করেছেন। আপনি এই বিমানে স্থির রয়েছেন, কোন নড়াচড়া হচ্ছে না কিন্তু বিমানটি আপনাকে নিয়ে চলছে। আপনি বিমানের জন্য স্থির আর বিমানটি পৃথিবীর জন্য চলমান। একস্থান থেকে অন্য স্থানে চলে গিয়েছে। অতএব নড়াচড়া অবশ্যই অন্য কিছুর সাথে সম্পর্কিত। এর উত্তর আমরা পবিত্র কুরআনেই পেয়ে থাকি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
الله الذي جعل لكم الأرض قرارا (سورة غافر 64)
আল্লাহ তোমাদের জন্য পৃথিবীকে স্থির করেছেন। (সূরা গাফের ৬৪)
পৃথিবীর ঘুরছে এমন অবস্থায়ও তোমাদের জন্য স্থির করে বসবাসের উপযোগী করেছেন। এতেই মহানকরুণাময় আল্লাহর কুদরতের সবচেয়ে বেশী বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
© 2014 by Tauhid Ahmed.